মার্কিন গলায় নরম সুর কেন?

 


র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকা অবস্থাতেই আইন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা কমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটির উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। বিচারবহির্ভূত হত্যা কমাতে র‌্যাবের কাজে উন্নতি দেখছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশকে জিএসপি সুবিধা দেয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম দেশ হবে বলে জানান মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কিন গলায় হঠাৎ নরম সুর কেন? এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কী স্বার্থ!

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাব ছাড়াও এ বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। বেনজির আহমেদ এবং র‍্যাব-৭-এর সাবেক কমান্ডার মিফতাহ উদ্দিন আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। র‍্যাবও প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছ থেকে যেসব সহযোগিতা পাচ্ছিলো সেগুলোও বাতিল হয়। একই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তিদের বিদেশে সম্পদ থাকলে সেগুলো বাজেয়াপ্তের কথা জানানো হয়।


এরপর বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বলা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাড়া মেলেনি। তবে এখানেও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও বিদেশে সরকারবিরোধীদের প্রপাগাণ্ডার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও তার প্লট শুরু হয় ২০১৮ সালে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই র‌্যাবের সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে হঠাৎ করে কী এমন হয়েছে যে, নিষেধাজ্ঞা দিতে হলো? বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, র‍্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রতিষ্ঠা এবং মার্কিন মনোভাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সরকারবিরোধী বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর নিবিড় জনসংযোগ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এসব তৎপরতার কারণেই ১০ জন মার্কিন সিনেটর ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং ট্রেজারি সেক্রেটারি স্টিভেন মুন্সিনকে লেখা চিঠিতে র‌্যাবের সিনিয়র কমান্ডারদের বিরুদ্ধে ‘টার্গেটেড স্যাংশন’ আরোপের অনুরোধ জানান।

নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ জানিয়ে নিজেদের অবস্থানে অটল থাকার কথা জানায় বাংলাদেশ। দীর্ঘ এক বছর র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞ নিয়ে নানা টালবাহানার পর সুর নরম করেছে যুক্তরাষ্ট্র। রোববার (১৫ জানুয়ারি) ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে আলোচনা এবং দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবকে নিয়ে প্রশংসা ঝরে লুর কণ্ঠে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বছর বাদে বিচারবহির্ভূত হত্যা কমাতে র‌্যাবের উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু।

র‌্যাবের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে লু বলেন, চলতি সপ্তাহে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে র‌্যাব অসামান্য অগ্রগতি করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা অসাধারণ কাজ উল্লেখ করে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান রেখে র‌্যাব সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে সক্ষম হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের অবস্থান নমনীয় করেছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, যে র‍্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেই র‌্যাবের প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন সহায়তাসহ সব ধরনের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

শুধু তাই নয়, র‌্যাব গঠনের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সম্পৃক্ততা ছিল উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘র‌্যাব যখন তৈরি হয় তখন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পরামর্শেই তৈরি হয়। সেই সময়ের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ওই দেশগুলো র‌্যাবের কনসেপ্টটা দেয়। তারাই তৎকালীন সরকারকে এ জন্য ইকুইপমেন্ট দেয়। তাদের কারণেই প্রাথমিকভাবে র‌্যাব চালু হয়। বাংলাদেশ সরকারকে কাবু করাই ওয়াশিংটনের অন্যতম উদ্দেশ্য বলেও মনে করেন অনেকে।

চিলির পিনোশেট বা আর্জেন্টিনার সামরিক শাসক হোর্হে ভিদালকে মানবাধিকার লংঘনের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। অথচ পিনোশেট ও ভিদালকে উসকানি এবং তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয় খোদ যুক্তরাষ্ট্রই। আবার বিচারের ব্যবস্থাও তারাই করে। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণকে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বলছেন বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে কোনো দেশকে কখনো সন্ত্রাসাবাদী, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। আবার কখনো নিজের স্বার্থে কাউকে কাউকে মানবতার কান্ডারি হিসেবে তকমা দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসে তাদের এ আচরণ অনেক পুরনো। অথচ নিজেদের দেশে মানবাধিকারের নামে কী হয় সে খবর বোধহয় মার্কিন কর্তারা কমই রাখেন। শুধু এক নিউইয়র্ক শহরে প্রতিদিন কতগুলো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে সে হিসেব কে রাখে? নিজ দেশের কালো নাগরিকদের সঙ্গে তারা কেমন আচরণ করে - সেই প্রশ্নও বা কে তোলে?

আরও পড়ুন: বাংলাদেশকে যে বার্তা দিয়ে গেলেন ডোনাল্ড লু

বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রশ্নে সুর নরম করা যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যও দেখছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, ভূরাজনীতির ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন পররাষ্ট্রনীতির কৌশল গ্রহণ করে। বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবধিকার রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিকঠাক করার কৌশল হাতে নিয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আর এ ক্ষেত্রেও মূলত যুক্তরাষ্ট্রের মূল টার্গেট চীন।

চীনকে ঠেকাতে বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আকসা ও জিসোমিয়া চুক্তি সই করাতে তৎপর বাইডেন প্রশাসন। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি দাবি করা হলেও তখন অনেকটা নীরবই ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন না তুললেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থেই প্রশ্ন তুলছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, উন্নয়ন সহযোগিতার নামে বাংলাদেশে ক্রমাগত চীনের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ও আধিপত্য নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। আর তাই চীনকে ঠেকাতেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধোঁয়া তুলে বাংলাদেশকে বশে আনার চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিজের অবস্থানে অটল থাকায় যুক্তরাষ্ট্রই সুর নরম করতে বাধ্য হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে যেমন গুরুত্ব বহন করে, তেমনি গেলো এক দশকে আর্থ সামাজিক অবস্থায়ও বাংলাদেশের প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। সক্ষমতা বেড়েছে ব্যাপক। বাংলাদেশ এখন পরাশক্তির চোখে চোখ রেখে নিজের কথা বলতে পারে। এছাড়া বিপরীত ধর্মী দুই বড় প্রতিবেশী ভারত এবং চীনের সঙ্গে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখছে, এ বাংলাদেশ ধমকে ভয় পাওয়ার বাংলাদেশ নয়; এ বাংলাদেশ নতজানু বাংলাদেশ নয়; এ বাংলাদেশ শিরদাড়া সোজা করে দাঁড়ানো বাংলাদেশ। ফলে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর এখন আবার মার্কিনিদের গলায় নমনীয়তার সুর।

বিশ্ব এখন আর একক শক্তি বা দুয়েকটি বড় বলয়ে আবদ্ধ নয়। বিশ্ব এখন বহু শক্তির দেশ। পুরনো পরাশক্তিরাও এখন সমঝোতার কথা বলছে বা বলতে বাধ্য হচ্ছে।

Comments

Popular posts from this blog

যেসব কথা বলে বাংলাদেশে মার খেয়েছি, সেসব এখন মানা হচ্ছে

পুলিশ বলল ‘নেই’, হাজতখানা থেকে স্বামী চিৎকার করে স্ত্রীকে বলল ‘আছি’

সরকার পতন, বিএনপিসহ ৩৬ দলের পদযাত্রা শুরু আজ