পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙালির উপর ঝাপিয়ে পড়ে


বাঙালি জাতীয়তাবাদি বুদ্ধিজীবীরা একটা ফিকশনকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে তা হল বাঙালিরা একদম আলাভোলা চুপচাপ ছিল। পাকিস্তানিরা নিরীহ বাঙালির উপর হামলা করে। 

তবে বাস্তবতা হল শেখ মুজিব একদিকে বক্তব্য দিচ্ছিলেন বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। অন্যদিকে তার ভারত থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ক্যাডার বাহীনিকে লেলিয়ে দেয় অবাঙালিদের পেছনে।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ একটা ঘটনা উল্লেখ করেছেন(গর্ব সহকারে), 

❝ ২৬ অক্টোবর (১৯৬৯) শেখ মুজিব কয়েক দিনের জন্য লন্ডন সফরে যান। সবাই জানত তিনি আগরতলা মামলা চলাকালে প্রবাসী বাঙালিদের এবং তাঁর কৌসুলি স্যার টমাস উইলিয়ামকে কৃতজ্ঞতা জানাতে লন্ডনে যাচ্ছেন । যাওয়ার আগে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর নীলক্ষেত-বাবুপুরা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আজিমপুর-নিউ পল্টন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম তালুকদারকে ইঙ্গিতে বলেন, ‘লাল ফিতা পেলেই ধরবে।' লাল ফিতা বলতে তালুকদার বুঝলেন পাঞ্জাবি সেনা। ৩ নভেম্বর তালুকদার নীলক্ষেতে তাঁর অফিসে বসে কাজ করছিলেন। সেখানে মন্টু, খসরু এবং আরও কয়েকজন ছিলেন। খবর এল, নিউমার্কেটের ভেতরে সেনা ঢুকেছে । কয়েকজনের গায়ে ইউনিফর্ম, বাকিরা সাদাপোশাকে। তখন বেলা ১১টা। নিউমার্কেটের ১ নম্বর ও ২ নম্বর গেটের মাঝামাঝি জায়গায় তাঁদের ওপর অতর্কিতে হামলা হলো । পিটিয়ে এবং ছুরি মেরে কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। ❞

১৯৭১ সালে তাদের সশস্ত্র কর্মকান্ড ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পরে। ১লা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা মাহবুবের নেতৃত্বে রেজিষ্ট্রার ভবনের ন্যাশনাল ব্যাংক (বর্তমান সোনালী ব্যাংক ) ও টিএসসির ইউনাইটেড ব্যাংকের (বর্তমান জনতা ব্যাংক) বন্দুক ডাকাতি করে। সেই বন্দুক দিয়ে কলাভবনের ছাদে বন্দুকের প্রশিক্ষণ হতো।

২ মার্চ আওয়ামী লীগের ক্যাডারেরা নিউমার্কেট ও বায়তুল মোকাররমের অস্ত্র দোকানগুলো থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। তারা এসব অস্ত্র ট্রাকে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে যায়। সেখানে ছাত্ররা একটি উন্মুক্ত ফায়ারিং রেঞ্জে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। তারা অবাঙালিদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট ও সিনেমা হল লুট করতো।

এছাড়া তারা ঢাকা শহরে বিহারি, গুজরাটি, মনিপুরী, আসামি সহ সব অবাঙালিদের আবাসিক এলাকায় হামলা করে। মুক্তিপণ আদায়ে ধনী পশ্চিম পাকিস্তানিদের অপহরণ করা হয়। ফলে আতঙ্কিত বহু অবাঙালি সেনানিবাসে আশ্রয় গ্রহন করে। 

৩ মার্চ পল্টন ময়দানে এক সমাবেশে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার' পাঠ করেন। অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার পক্ষে চার ছাত্র নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব এবং আবদুল কুদ্দুস মাখন শপথ বাক্য পাঠ শেষে ‘জয়বাংলা বাহিনী'র উপ-প্রধান (ডেপুটি চীফ) কামরুল আলম খান খসরু আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গান ফায়ার’ করে সশস্ত্র যুদ্ধের ঘোষণা জানান।

একই দিনে ৩ মার্চ আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কর্মীদের নেতৃত্বে উন্মত্ত জনতা ঢাকার নবাবপুর, ইসলামপুর ও পাটুয়াটুলির মতো জায়গায় হাজার হাজার অবাঙালির বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড চালায়। জিন্নাহ এভিনিউতে অবাঙালি মালিকানাধীন বহু দোকানপাট লুট করা হয়। শহরের উপকণ্ঠে একটি বস্তিতে অবাঙালিদের ৫০টি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং তাদের অনেকে জীবন্ত দগ্ধ হয়। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের নির্দেশে ঢাকায় টেলিভিশন ও রেডিও স্টেশনে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথের পূর্ব বাংলা বিরোধী গান ‘আমার সোনার বাংলা' বাজানো হয়।

৬ মার্চ ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে ৩৪১জন কয়েদী পালিয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের সঙ্গে যোগ দেয়।  ককটেল এবং বোমা তৈরির উদ্দেশ্যে ছাত্র লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরী ও পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে রাসায়নিক বিস্ফোরক লুট করে। 

১৬ থেকে ২৩ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের আড়ম্বরপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক আলোচনার সময়ও আওয়ামী লীগ তাদের সমান্তরাল সরকারের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে এবং ঢাকা ও তার আশপাশের কয়েকটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দলীয় ক্যাডারদের প্রকাশ্যে প্রশিক্ষণ দেয়। অবাঙালিদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। 

একদল দাঙ্গাবাজ ক্যাডার ঢাকায় সেনাবাহিনীর একটি জীপে হামলা চালায় এবং জীপের আরোহী ৬ সৈন্যকে অপহরণ করে। শহরে পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করা হয়। ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে খাদ্য সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। 

২২ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামের পাশে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের নিয়ে সশস্ত্র সমাবেশ করেন এম‌এজি ওসমানী। সেখানে একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা 'অনেক রক্ত দিয়েছি এবার শোধ নেব।'

২৩ মার্চ চীনা কন্স্যুলেটে লীগের বানানো নতুন পতাকা উত্তোলন করতে গেলে লীগের সঙ্গে তাদের বিরোধ বাধে। চীনারা তাদেরকে এ পতাকা উত্তোলনে বাধা দেয়। আওয়ামী লীগের বিক্ষোভকারীরা বহু স্থানে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা টুকরো টুকরো করে এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি পায়ের নিচে পিষ্ট করে। ইপিআর ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা সপক্ষ ত্যাগ করায় আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের শক্তি বৃদ্ধি পায়।

পুরো প্রদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়৷ ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি ছিল আরো ভয়াবহ। নির্বাচনের আগে থেকেই সারা দেশে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু হয়। ফটিকছড়িতে নাজিরহাট কলেজের নিউক্লিয়াস কমান্ডার আনোয়ারুল আজিম ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে যুদ্ধের জন্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুর করে। 

কুষ্টিয়াতে আওয়ামী লীগের ক্যাডারেরা একজন লাহোরের অধিবাসী সরকারি কর্মকর্তা ওয়াকার নাসিম বাটের মাথা কেটে, কাটা মাথা নিয়ে আনন্দ মিছিল করে (ছবিতে)। 

খুলনা, চট্রগ্রাম, ময়মনসিংহসহ সারা দেশে বিহারিদের উপর হত্যাযজ্ঞ চলে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে এর ভয়াবহতা ছিল সবচেয়ে বেশি। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, সৈয়দপুরে হাজার হাজার বিহারিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। 

বাঙালিদের প্রিয় সাংবাদিক এন্থনি মাসকোরেনহাস সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে লিখেছিলেন,

❝ হাজার হাজার দুর্ভাগা মুসলমান পরিবারের সদস্যদের—যাদের অনেকেই বিহার থেকে আগত শরণার্থী—নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছিল বা বিশেষভাবে তৈরি ছুরি দিয়ে তাদের স্তন কেটে ফেলা হয়েছিল। শিশুরাও এই বিভীষিকা থেকে রেহাই পায়নি: যারা সৌভাগ্যবান ছিল, তারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গেই নিহত হয়েছে; কিন্তু হাজার হাজার অন্যদের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নির্মমভাবে কেটে ফেলা হয়েছে, এক ভয়ংকর অমানবিক জীবনের শাস্তি দিতে তাদের বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

চট্টগ্রাম, খুলনা এবং যশোরের মতো প্রধান শহরগুলোতে ২০,০০০-র বেশি অবাঙালির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। পূর্ব বাংলার সর্বত্র আমাকে বলা হয়েছিল যে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এক লাখ পর্যন্ত হতে পারে; কারণ হাজার হাজার অবাঙালি নিখোঁজ হয়ে গেছে, যাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ❞

— অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, দ্য সানডে টাইমস, ১৩ জুন, ১৯৭১

ইতিহাসবেত্তা প্রফেসর তাজ হাশমি এক লাইনে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে অবাঙালিদের অবস্থা কেমন ছিল তা বিশ্লেষণ করে।,

❝ যেভাবে না-ৎসিরা জার্মানিতে ইহুদিদের উপর হ-ত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো ঠিক একই কায়দায় বাঙালিরা বিহারিদের উপর হ-ত্যাযজ্ঞ চালায়। ❞ 

এ সময় আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকরা খোদ ঢাকার পুলিশ হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করে প্রায় ১৫ হাজার লোড করা রাইফেল লুট করে। গোটা ঢাকা শহর জুড়ে ব্যারিকেড ও সড়ক প্রতিবন্ধকতা দেখা যায়। বিভিন্ন স্থানে পেট্রোল বোমা, ককটেল বিস্ফোরিত হয়।

সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পারে আওয়ামী লীগ ২৬ মার্চ প্রত্যুষে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সহায়তায় একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটাতে যাচ্ছে। সশস্ত্র অভ্যুত্থান অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা আগে ২৫ মার্চ গভীর রাতে সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে আসে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রাদেশিক রাজধানীতে বেশ কয়েকটি জায়গায় আগেভাগে আঘাত হানে এবং আওয়ামী লীগের অভ্যুত্থান নস্যাত করে দেয়।

বিস্তারিত পড়াশোনা:

১। ডেড রেকনিং, শর্মিলা বোস

২। ব্লাড এন্ড টীয়ার্স, কুতুবউদ্দিন আজিজ 

৩। 50 years of Bangladesh, Prof. Taj Hashmi, (Chapter 7)

৪। আওয়ামী লীগ, উত্থান পর্ব, মহিউদ্দিন আহমেদ পৃ: ২০৯

৫। আওয়ামী লীগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের ফেইসবুক পোস্ট

লিখেছেন, Mir Salman Samil

Previous Post Next Post

Contact Form