নেজামকে হত্যার নির্মমতা অন্ধকার যুগকেও হার মানিয়েছে!


সাতকানিয়ায় জামায়াতকর্মী নেজাম উদ্দিনকে ডাকাতের তকমা লাগিয়ে গণপিটুনির নামে গুলি করে, কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় নিহতের স্ত্রী আরজু আকতার (৩০) বলেছেন, ‘এই নির্মমতা অন্ধকার যুগকেও হার মানিয়েছে। তার অপরাধ ছিল, সে জামায়াত ইসলামীর কর্মী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী ও গরিব অসহায় মানুষের বন্ধু।’

গত সোমবার (৩ মার্চ) চট্টগ্রামে সাতকানিয়ায় এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় ডাকাতির গুজব রটিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।

আরজু আকতার (৩০) কাঞ্চনা ইউনিয়েনের মধ্যম কাঞ্চনা জোট পুকুরিয়া পোস্ট অফিস এলাকার মরহুম মাহমুদুল হকের ছেলে নিহত জামায়াত কর্মী নেজাম উদ্দিনের স্ত্রী।

আরজু আকতার বলেন, ‘এ কেমন নির্মমতা ও নৃশংসতা? স্বৈরাচারের দোসরদের খুঁজতে এবং একটি সালিশি বৈঠকে গিয়ে ডাকাতের তকমা দিয়ে গণপিটুনির নামে গুলি করে, কুপিয়ে ও বেধড়ক পিটিয়ে একটি জীবন্ত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা? এ দেশের নাগরিকদের বেঁচে থাকার কি কোনো মৌলিক অধিকার নেই? যদি সে ডাকাতও হয়ে থাকে তাহলে তাকে এভাবে নৃশংস কায়দায় হত্যার কি দরকার ছিল? তাকে আটকের পর মারধর করে পুলিশের কাছে তুলে দিতে পারত। অপরাধী হয়ে থাকলে আইনের মাধ্যমে তার বিচার হতো। তাকে যেভাবে নির্মম কায়দায় কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাতে বুঝা যাচ্ছে ডাকাতির নাটক সাজিয়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাকে মেরে ফেলার মতো কি অপরাধ ছিল তার?’

তথ্যসূত্রে জানা যায়, গত (৩ মার্চ) সোমবার এওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নজরুল ইসলাম মানিকের ভাই হারুন, মমতাজ ও তার বিশ্বস্ত আস্থাভাজন কামরুলসহ বেশকিছু অনুসারীরা জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করার জন্য ছনখোলা পশ্চিম পাড়া এলাকায় গোপন মিটিং করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে এবং একটি সালিশি বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে জামায়াতকর্মী নেজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ ছালেকের (৩৫) নেতৃত্বে কয়েকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় বেশকিছু যুবক ঘটনাস্থলে যায়।

এ সময় তারা ঘটনাস্থলে বিচার সালিশ শেষ করে মানিক চেয়ারম্যানের ভাই ও তার অনুসারীদের গোপন মিটিংয়ের বিষয় সম্পর্কে তথ্যের সত্যতা না পেয়ে তাদের সাথে অটোরিকশায় করে যাওয়া যুবকদের বিদায় দিয়ে নেজাম ও ছালেক ঘটনাস্থলে থেকে যায়। এ সময় তারা সেখানে একটি চায়ের দোকানে বসে তাদের পূর্ব পরিচিত কয়েকজন ব্যক্তির সাথে বসে চা-নাস্তা খেয়ে গল্প করছিল।

গল্প করার এক ফাঁকে দোকান থেকে স্থানীয় এক ব্যক্তি বের হয়ে মসজিদের মাইকে গিয়ে ঘোষণা করেন এলাকায় ডাকাত এসেছে। মাইকে এমন ঘোষণার পর স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে হত্যার পরিকল্পনাকারী ব্যক্তিরা একত্রিত হয়ে নেজাম ও ছালেককে ঘিরে ফেলেন। এ সময় সেখানে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা গুলি ছোঁড়লে গুলিতে ৪/৫ জন এলাকাবাসী গুলিবিদ্ধ হয়।

গুলিবিদ্ধের ঘটনাকে পুঁজি করে হত্যার পরিকল্পনাকারীরা একত্রিত হয়ে ডাকাত ডাকাত বলে জামায়াতকর্মী নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ ছালেকের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে হত্যার পরিকল্পনাকারীরা ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর সাথে মিশে গিয়ে তাদেরকে উপর্যপুরি কুপিয়ে ও পিটিয়ে ঘটনাস্থলে হত্যা করে।

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চনা জোট পুকুরিয়া পোস্ট অফিস এলাকার মরহুম মাহমুদুল হকের ছেলে জামায়াতকর্মী নেজাম উদ্দিনের গর্ভধারণী মা ২০০৪ সালে আর বাবা ২০০৭ সালে মারা যান।

পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে সবাই বিবাহিত। এদের মধ্যে নেজাম উদ্দিনের এক বড় বোন রাশেদা বেগম ও এক ছোট ভাই সাইফুদ্দীন (প্রবাসী) মারা গেছেন। বড় ভাই কামাল উদ্দিন ও নাছির উদ্দিন (প্রবাসী)। ছোট ভাই আবছার উদ্দিন ব্যবসায়ী। অন্য দুই বোন সাজেদা বেগম ও জাহেদা বেগম বিবাহিতা।

নেজাম উদ্দিন এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করে কর্মজীবনে নেমে পড়েন। ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগের অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণে সৌদি আরবে প্রবাসী হন। সেখানে এক দোকানে চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকার এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে নেজামের বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ে ঠিক হলেও কিন্তু আওয়ামী লীগের দুঃশাসন মামলা হামলা ও জীবনের ভয়ে বিয়ে করতে দেশে আসতে পারছিলেন না। সে কারণে মেয়ে পক্ষের লোকজন মেয়েকে সৌদি আরবে নিয়ে যান। সেখানে ২০১৮ সালের ৩ নভেম্বর আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা আবদুল মজিদের মেয়ে আরজু আকতারের সাথে নেজামের বিয়ে হয়। বিয়ের একমাস পরে নেজামের স্ত্রী আরজু আকতার দেশে চলে আসেন। এরই মধ্যে নেজামের ভিসাগত সমস্যা হওয়ায় সে ২০১৯ সালের ৮ মার্চ দেশে চলে আসেন। দেশে আসলেও আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম মানিক ও পুলিশের ভয়ে সে গ্রামে আসতে পারেননি।

চট্টগ্রাম শহরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে কোনো রকম আত্মগোপন করে জীবন যাপন করছিলেন।

নিহত নেজাম উদ্দিনের শ্বশুর আবদুল মজিদ জানান, নেজাম দেশে চলে আসার পর চট্টগ্রাম শহরে কোনো রকম জীবন যাপন করলেও তার জীবনের নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তা করে আমি তাকে শহর থেকে আমাদের গ্রামে নিয়ে আসি। সেখানে তাকে মোহছেন আওলিয়ার মাজার এলাকায় একটি বাসা ঠিক করে দেই। সেখানেও তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কয়েকবার বাসার স্থান পরিবর্তন করেছি।

নিহত জামায়াতকর্মী নেজাম উদ্দিনের স্ত্রী আরজু আকতার চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আক্ষেপ করে বলেন, ‘আসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো কি আমার স্বামীর অপরাধ? সে কারণে কি আমার স্বামীকে ডাকাতের মিথ্যা তকমা লাগিয়ে কুপিয়ে ও পিঠিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’

তিনি খুনিদের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এভাবে একটি জীবন্ত মানুষকে মেরে ফেলে আমার আড়াই বছরের শিশু সন্তানকে বাবার আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে কেন বঞ্চিত করেছ? আমার আরেক অনাগত সন্তানকে তার বাবার মুখ দেখতে দাওনি। তাদেরকে চিরদিনের মতো এতিম করে দিয়েছো আর আমাকে করেছ স্বামীহারা বিধবা।’

আরজু আকতার আরো বলেন, ‘আমার জানা মতে আমার স্বামী কোনো অপরাধের সাথে জড়িত ছিল না। তার শুধু মাত্র অপরাধ সে জামায়াত ইসলামীর কর্মী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী ও গরিব অসহায় মানুষের বন্ধু ছিল। তোমরা এভাবে পিটিয়ে আমার স্বামীকে হত্যা করেছ এখন আমার ও সন্তাদের দায়িত্বভার কে নেবে? এখন আমাদের মাথা গোঁজার মতো কোনো ঠাঁই নেই। থাকার মতো কোনো ঘরবাড়ি নেই। আমার ছেলেদের ভবিষ্যৎ গড়ার মতো কোনো সামর্থ্য নেই।’

তিনি জানান, ঘটনার দিন এশার নামাজের আগে সে আমাকে একটি বিচার সালিশে যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল। সেই বের হওয়া যে তার শেষ বারের মতো বের হওয়া তা আমি বুঝতে পারি নাই।

নেজামের স্ত্রী আরো বলেন, ‘আমার স্বামী দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে এওচিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম মানিক ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছিল। দীর্ঘদিন সে গ্রামের বাড়িতে আসতে পারেনি। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ তারিখ সে গ্রামের বাড়িতে আসেন। আর আমি ১৫ তারিখে শ্বশুর বাড়িতে আসি। দীর্ঘদিন সে গ্রামের বাইরে থাকার কারণে এলাকায় কোনো ঘরবাড়ি করতে পারেনি। এখন আমরা আমার স্বামীর ভাইদের ভাঙ্গা একটি বাড়ির বারান্দায় পর্দা দিয়ে কোনো রকম জীবন যাপন করছিলাম। কিন্তু খুনিরা ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে আমার স্বামীকে মিথ্যা অভিযোগের কালিমা লেপন করে পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট আমার স্বামীর বন্ধু জামায়াতকর্মী আবুল বশরকে পুলিশের সহযোগিতায় একইভাবে এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় মানিক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আবুল বশরকে হত্যার পর থেকে ওই খুনি মানিকের রোষানলে ছিল আমার স্বামী। এরই ধারাবাহিকতায় নজরুল ইসলাম মানিক দুবাই থেকে সৌদি আরবে গিয়ে সেখানে একটি জায়গায় গোপন মিটিং করে আমার স্বামীকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় গত ৩ মার্চ (সোমবার) রাতে মানিক চেয়াম্যানের ভাই হারুন, মমতাজ ও তার একান্ত সহযোগী কামরুলের নেতৃত্বে ডাকাতের নাটক সাজিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আমার স্বামীকে হত্যা করে তাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। আমি আমার স্বামী হত্যার সাথে যারা জড়িত সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দাবি করছি।’

এদিকে নিহত জামায়াতকর্মী নেজাম উদ্দিনের আড়াই বছরের শিশু সন্তান আদনান বিন নেজাম ঘটনার দিন শেষবারের মতো তার বাবার সাথে ইফতারির সময় খাবার খেয়েছিল। সেদিন থেকে ৫ দিন ধরে তার অবুঝ ছেলেটি কোনো ধরণের খাবার মুখে নেয়নি বলে জানান তার মা আরজু আকতার। শুধু বাবা বাবা বলে কান্নাকাটি করছে আর পথের দিকে চেয়ে রয়েছে কখন ঘরে ফিরবে তার বাবা। সে জানেনা যে তার বাবা আল্লাহর জিম্মায় চলে গেছেন আর কোনো দিন ঘরে ফিরবে না।

এলাকাবাসীরা জানান, জামায়াতকর্মী নেজাম উদ্দিন ছিল খুব শান্ত স্বভাবের। সদা হাস্যউজ্জ্বল ও কর্মচঞ্চল ছিল। কখনো কারো সাথে ঝগড়া বিবাদে জড়ায়নি। এলাকার অসহায় মানুষের পাশে থাকা ছাড়াও সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখত সবসময়। সবার সাথে ভাল সম্পর্ক রেখে চলত সে। এ রকম একজন উদীয়মান যুবককে হারিয়ে এলাকাবাসী শোকের সাগরে ভাসছে।

Previous Post Next Post

Contact Form